তাকওয়া কী?
তাকওয়া শব্দটি আরবি التقوي (আত তাকওয়া) থেকে এসেছে। তাকওয়ার শাব্দিক অর্থ হলো বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, ভয় করা, নিজেকে রক্ষা করা, বর্জন করা, সংযত হওয়া, আত্মশুদ্ধি, খোদাভীরুতা ইত্যাদি।
ইসলামী পরিভাষায়- আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির আশায় এবং অসন্তুষ্টির ভয়ে যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলা হয়। যিনি তাকওয়া অবলম্বন করেন, কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করেন, তাকে বলা হয় মুত্তাকী।
তাকওয়া অবলম্বনের গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
يَاَيُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا اتَّقُوا اللّٰهَ حَقَّ تُقاتِهٖ وَلَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَاَنۡـتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ
অর্থ— হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমনিভাবে ভয় করা উচিত ঠিক তেমনি ভাবে ভয় কর এবং মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। [1]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন—
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ
অর্থ— হে মানব মন্ডলী! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। [2]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
وَاتَّقُوا الله وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
অর্থ: আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখো নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। [3]
এভাবে পবিত্র কুরআন মাজীদের বহুসংখ্যক আয়াতে করিমায় আল্লাহকে ভয় করা তথা তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ রয়েছে। অতএব তাকওয়া হলো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর ভয়কে অন্তরে জাগ্রত রাখা। বান্দার প্রতিটি কাজকর্ম, চলাফেরা, লেনদেন, আচার ব্যবহার সবকিছুই আল্লাহর ইলিম ও কুদরতে আবদ্ধ। কোন কিছুই বান্দা আল্লাহ থেকে গোপন রাখতে পারে না। সবার চোখ ফাঁকি দেয়া যায়, দুর্নীতি করা যায়, বিশৃঙ্খলা করা যায়, দায়িত্বে অবহেলা করা যায়, আমানতের খেয়ানত করা যায়, কিন্তু আল্লাহর কুদরতি দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়া যায় না। তাই আল্লাহর ভয়কে সদা সর্বদা অন্তরে জাগরূক রেখে আল্লাহর হুকুম পালন করার নাম তাকওয়া।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) এর মতে তাকওয়া
ইবনে আবিদ দুনিয়া স্বীয় “তাকওয়া” গ্রন্থে বর্ণনা করেন—
عن ابي هريره رضي الله تعالى عنه ان رجلا قال له ما التقوى؟ قال أتخذت طريقا ذا شوك؟ قال نعم قال فكيف صنعت؟ قال أذا رأيت الشوك عدلت عنه او جاوزته او قصرت عنه قال ذلك التقوى—
অর্থ— হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন— তাকওয়া কি? তিনি সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কখনো কাঁটাযুক্ত রাস্তায় গমন করেছ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, সেই কাঁটাযুক্ত রাস্তা কিভাবে অতিক্রম করেছ? তিনি বললেন, যখন আমি কাঁটা দেখতে পেয়েছি, তখন রাস্তা পরিবর্তন করেছি অথবা পরিহার করেছি অথবা ইহা থেকে সংক্ষিপ্ত করেছি। আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, ইহাই হচ্ছে তাকওয়া। [4]
হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.) এর মতে তাকওয়া
হাফিজ ইবনে কাসির আরেকটি বর্ণনা নকল করেছেন নিম্নরূপ—
وقد قيل ان عمر بن الخطاب رضي الله تعالى عنه سأل أبي أبن كعب عن التقوي فقال له أما سلكت طريقا ذا شوك؟ قال بلي قال فما عملك؟ قال شمرت وأجتهدت قال فذلك التقوى
অর্থ— বর্ণিত আছে যে, একবার ওমর বিন খাত্তাব (রা.) উবাই বিন কাব (রা.) কে প্রশ্ন করলেন, তাকওয়া কী? জবাবে উবাই বিন কা’ব (রা.) বললেন, আপনি কি কখনো কাঁটাযুক্ত কোন রাস্তা দিয়ে গমন করেছেন? ওমর (রা.) জবাবে বললেন, হ্যাঁ। উবাই বিন কা’ব (রা.) বললেন, তখন আপনি কিভাবে অতিক্রম করেছেন? ওমর (রা.) বললেন, আমি চিন্তা ভাবনা করে সাবধানতার সাথে অতিক্রম করেছি। উবাই বিন কা’ব (রা.) বললেন, ইহা হচ্ছে তাকওয়া। [5]
তাকওয়ার স্তর ও প্রকারভেদ
উলামায়ে কিরাম তাকওয়ার স্তর ও প্রকারভেদ বর্ণনা করতে গিয়ে তাকওয়াকে সাধারণত: তিন প্রকারে বিভক্ত করেছেন।
প্রথম প্রকার: প্রতিটি মুমিন মুসলমান যাবতীয় শিরক ও কুফুরী গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
দ্বিতীয় প্রকার: প্রতিটি মুমিন মুসলমান ফরয ওয়াজিব আমল যথাযথ আদায়ের সাথে সাথে হারাম কাজ তথা গুনাহে কবিরা থেকে বেঁচে থাকা।
তৃতীয় প্রকার: প্রতিটি মুমিন মুসলমান ফরয ওয়াজিবসহ মুস্তাহাব ও নফল আমল আদায়ের সাথে সাথে মাকরূহ ও মুবাহ আমল তথা সগীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা হাফিজ ইবনে কাছির (র.) তদীয় তাফসীর গ্রন্থে তাকওয়াকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা ফাতির এর ৩২ নং আয়াত উল্লেখ করে বলেন: আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন—
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِينَ أصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا ۖ فَمِنْهُمْ ظَالِمٌۭ لِّنَفْسِهِۦ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌۢ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللَّهِ ۚ
অর্থ: অতঃপর আমি এই কিতাবটির উত্তরাধিকারী করেছি আমার বান্দাহদের মধ্যে তাদেরকে, যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি। তারপর তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী এবং কেউ কেউ মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী। আবার তাদের কেউ কেউ আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী। [6]
হাফিজ ইবনে কাছির (র.) এর মতে তাকওয়া ৩ প্রকার
হাফিজ ইবনে কাসির (র.) বলেন-
ثم قسم ألى ثلاثة أنواع فقال (فمنهم ظالم لنفسه) وهو المفرط في فعل بعض الواجبات المرتكب لبعض المحرمات (ومنهم مقتصد) وهو المؤدي للواجبات التارك المحرمات وقد يترك بعض المستحبات ويفعل بعض المكروهات (ومنهم سابق بالخيرات بأذن الله) وهو الفاعل للواجبات والمستحابات التارك للمحرمات والمكروهات وبعض المباحات
অর্থ: অতঃপর ইহাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
প্রথম- (তাদেরকে কেউ নিজের প্রতি জুলুমকারী ) সে হলো এমন ব্যক্তি, যে কোন কোন ওয়াজিব আমল ছেড়ে দেয় এবং কোন কোন হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে যায়।
দ্বিতীয়- (তাদের কেউ কেউ মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী) সে হলো এমন ব্যক্তি, যে ওয়াজিব বিষয়াদি পালন করে এবং হারাম বিষয়গুলো ত্যাগ করে। তবে কোন কোন মোস্তাহাব বিষয় ছেড়ে দেয় এবং কোন কোন মাকরূহ বিষয় আমল করে ফেলে।
তৃতীয়- (তাদেরকে কেউ আল্লাহর হুকুমে কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী) সে হলো এমন ব্যক্তি, যে ওয়াজিব বিষয়সমূহ আমল করে সাথে সাথে মুস্তাহাব আমলও করে। হারাম কাজ পরিত্যাগ করে সাথে সাথে মাকরূহ বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে। আবার কোন কোন মোবাহ বা বৈধ কাজও পরিত্যাগ করে।[7]
হাফিজ ইবনে কাসীর এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হলো যে, আল্লাহকে ভয় করা বা তাকওয়ার দৃষ্টিতে প্রতিটি উম্মতে মোহাম্মদী ﷺ এর তিনটি স্তর রয়েছে—
এক- নিজের প্রতি জুলুমকারী ।
দুই- মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী।
তিন- কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী ।
প্রকৃতপক্ষে ইহাই তাকওয়ার তিনটি স্তর। কারণ যার অন্তরে যত বেশী তাকওয়া থাকবে, সে তত বেশি আল্লাহর হুকুম পালন করবে। পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। যার অন্তর তাকওয়া শূণ্য, সেই বেপরোয়া হয়ে আল্লাহর হুকুমের বরখেলাফ করবে।
ইমাম তাবারী (র.) এর মতে তাকওয়া ৩ প্রকার
ইমাম তাবারী (র.) স্বীয় তাফসির গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেন—
فالأتقاء الأول هو الأتقاء بتلقي أمر الله بالقبول والتصديق والدينونة به والعمل والأتقاء الثاني الأتقاء بالثبات على التصديق وترك التبديل والتغيير والأتقاء الثالث هو الأتقاء بالأحسان والتقرب بنوافل الأعمال
অর্থ- তাকওয়ার প্রথম স্তর হল আল্লাহর হুকুম—আহকাম সমূহ বিশ্বাস করে ঈমান এনে বাস্তবে আমল করা।
তাকওয়ার দ্বিতীয় স্তর হল বিশ্বাসকৃত ঈমান-আকিদার প্রতি দৃঢ় থাকা এবং পরিবর্তন পরিবর্ধন থেকে বিরত থাকা।
তাকওয়ার তৃতীয় স্তর হল ইহসান করা এবং নফল বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। [8]
ইমাম ইবনু জুযাই (র.) এর মতে তাকওয়া ৫ প্রকার
ইমাম ইবনু জুযাই (র.) التسهيل لعلوم التنزيل গ্রন্থে বলেন—
درجات التقوى خمس الأول أن يتقي العبد الكفر وذلك مقام الأسلام الثانية أن يتقي المعاصي والحرمات وهو مقام التوبة الثالثة أن يتقي الشبهات وهو مقام الورع الرابعة أن يتقي المباحات وهو مقام الزهد الخامسة أن يتقي حضور غير الله على قلبه وهو مقام المشاهدة
অর্থ: তাকওয়ার স্তর হলো পাঁচটি। এক— বান্দাহ কুফরী থেকে বেঁচে থাকবে। ইহা হলো ইসলামের ভিত্তি। দুই— বান্দাহ গুনাহ ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বেঁচে থাকবে। ইহা হলো মাকামে তাওবাহ। তিন— বান্দাহ সন্দেহপূর্ণ কাজ থেকে বেঁচে থাকবে। ইহা হলো মকামে ওয়ারা। চার— বান্দাহ মুবাহ বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে। ইহা হল মাকামে যুহুদ। পাঁচ— অন্তরে আল্লাহ ভীতি ব্যতীত অন্য কিছুকে উপস্থিত হওয়া থেকে বেঁচে থাকবে। ইহা হলো মাকামে মুশাহাদা। [9]
ইবনে কাইয়ুম আল জাওযিয়া বলেন—
التقوى ثلاث مراتب أحدها حمية القلب والجوارح عن الأثام والمحرمات والثانية حميتها عن المكروهات والثالثة الحمية عن الفضول ما لا يغني
অর্থ: তাকওয়ার স্তর হলো তিনটি। এক— কলব এবং অন্যান্য অঙ্গ—প্রত্যঙ্গকে গুনাহ ও হারাম কাজ থেকে নিরাপদ রাখা। দুই— এগুলোকে মাকরূহ বিষয় থেকে মুক্ত রাখা। তিন— নিজেকে অনর্থক ও বেহুদা কাজ থেকে মুক্ত রাখা। [10]
আলা হযরত (র.) এর মতে তাকওয়া ৭ প্রকার
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরলভী (র.) উল্লেখ করেছেন তাকওয়া ৭ প্রকার।
১। কুফর থেকে বিরত থাকা। এটা আল্লাহর অনুগ্রহে প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যেই রয়েছে।
২। ভ্রান্ত আকাঈদ ও মতবাদ থেকে বেঁচে থাকা। এটা প্রত্যেক সুন্নী মুসলমানের মধ্যেই অর্জিত রয়েছে।
৩। সকল কবিরাহ গুনাহ থেকে বিরত থাকা।
৪। সগীরা গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকা।
৫। সন্দেহযুক্ত বস্তু থেকে দূরে থাকা।
৬। রিপুর প্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকা।
৭। অন্যের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা। এটা বিশেষ ব্যক্তি বর্গের পরিচয়।[11]
মুফতি আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (র.) এর মতে তাকওয়া ২ প্রকার
আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খাঁন নঈমী (র.) উল্লেখ করেছেন— তাকওয়া দুই প্রকার। শারীরিক ও আত্মিক।
১। শারীরিক তাকওয়া হচ্ছে— পাপাচার সমূহ থেকে বেঁচে থাকা ও সৎকাজ করার নাম।
২। আত্মিক তাকওয়া হচ্ছে— আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার নাম। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন—
وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ
এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করে, নিশ্চয় তা হচ্ছে হৃদয়ের তাকওয়া। [12]
সূত্র:
তাকওয়া কী ও কেন?
কৃত: হাফিজ মুফতি মুহাম্মদ ইকরাম উদ্দিন, খতিব বৃস্টল সেন্ট্রাল মসজিদ,ইউ কে।
[1] সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং- ১০২
[2] সূরা নিসা, আয়াত নং- ১
[3] সূরা বাকারা, আয়াত নং- ১৯৪
[4] তাফসীরে দুররে মানসূর, সূরা বাকারা, আয়াত নং – ২
[5] তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা বাকারা, আয়াত নং – ২
[6] সূরা ফাতির, আয়াত নং- ৩২
[7] তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং- ১০২
[8] তাফসীরে তাবারী, সূরা মায়েদা, আয়াত নং- ৯৩
[9] আত তাসহিল লি উলুমিত তানজিল, ১/৬৯
[10] আল ফাওয়াঈদ, পৃষ্ঠা ৬৫
[11] কানযুল ঈমান ও খাজাইনুল ইরফান- সূরা বাকারা ২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
[12] প্রাগুক্ত